আমাদের নিজস্ব বলয়ে এমন কিছু জায়গায় রয়েছে, যা বারবার দেখার পরও তৃপ্তি মেটে না। এখানে যতবার এসেছি, ততবারই যেন অতৃপ্তির একটি কালো ছায়া মনে চেপে বসে। কর্মস্থল থেকে বেশি সময় ছুটি নিয়ে তো আর যাওয়া সম্ভব হয় না, তাই এক একবার গিয়ে মনের মাঝে উঁকি দেওয়া এক একটি ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করি৷ তবুও যেন পরিতৃপ্ত হতে পারি না। আসলে এসব জায়গা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক যে, বারবার দেখার পর মন অতৃপ্তই থেকে যায়। আমি বলছি মদিনার কথা৷
রাত নয়টায় বিমানে দাম্মাম থেকে মদিনার উদ্দেশে রওনা হলাম। ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট সময় নিয়ে বিমান পৌঁছে গেল মদিনার আকাশে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল এক স্থানে একটা ব্যতিক্রম আলোকসজ্জা৷ শহরের অন্যান্য আলোকসজ্জা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক ছোট ছোট গম্বুজ, দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যে অলংকৃত অবয়ব, সাদা মার্বেল পাথরে গড়া লম্বা লম্বা মিনার সংবলিত জায়গার তিন পাশে ঝাউগাছের মতো দণ্ডায়মান উজ্জ্বল-ধূসর রঙের দণ্ডবিশেষ (ছাদের বিকল্প, গুটিয়ে রাখা ছাতা), কর্নারে একটি সবুজ গম্বুজ, ছোট ছোট লিনটেলগুলো সবুজ, চারদিকে হ্যালোজেন বাতির ঝলমলে আলো, আড়াল থেকে ফোকাস করা সবুজ রশ্মি সাদা মার্বেল-পাথরের ওপর পড়ে অপরূপ শোভা ধারণ করে আছে৷
যাদুর পাহাড়যাদুর পাহাড়
এর প্রকৃত বর্ণনা আমার পক্ষে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়৷ সরাসরি চোখে দেখতে হবে। এটা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অতি কাঙ্ক্ষিত, অতিপ্রিয়, পরম সাধনায় সৌভাগ্যক্রমে দেখতে পাওয়া ও ইবাদত করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা পবিত্র মসজিদুন নববি এবং কর্নারে সবুজ গম্বুজ হলো আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.)–এর পবিত্র রওজা শরিফ। দৃষ্টিগোচর হতেই মন শীতল হয়ে যায়, দেখার আনন্দ ও আবেগে বুক ভারী হয়ে ওঠে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।
যথাসময়ে উড়োজাহাজ মদিনা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম মসজিদুন নববির কাছে পাঁচতারকা হোটেল ‘ইলাফ’–এর সামনে।
পরদিন সকালে নাশতা সেরে বের হলাম দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক জায়গাগুলো পরিদর্শন করতে৷ এর আগে দু-তিনবার দেখেছি, মন ভরেনি, কিছু কিছু জায়গা বাদ পড়েছিল। প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে দেখতে গেলাম জিনের পাহাড়৷ এর আগে কখনো দেখা হয়নি। বাংলা ভাষাভাষীরা কেউ বলে জিনের পাহাড়, কেউ বলে জাদুর পাহাড়। আবার কেউ কেউ বলে, ওয়াদি-ই-বাজা, ওয়াদি-ই-জিন, ঘোস্ট ভ্যালি (ভূতের উপত্যকা), তারিক-ই-জিন, তারিক-ই-বেদ ইত্যাদি। পাহাড়ে ঘেরা ওই পথে একটা নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে, যেখানে গাড়ি অটোমেটিক চলে, ঢালু থেকে উঁচুর দিকে যায়। মসজিদুন নববির দিক থেকে গাড়ি যখন ওই স্থান দিয়ে গমন করে, তখন (ঢালু পথে) গাড়ি ভারি হয়ে যায়, আপনা থেকেই গতিবেগ কমে যায় এবং সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি যেতে পারে, তা–ও প্রথম গিয়ারের মতো আওয়াজ হয়। ঠিক উল্টোভাবে ফিরে আসতে চাইলে গাড়ি আপনা থেকেই উঁচুর দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলে৷ শুধু গিয়ার নিউট্রাল রেখে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকলেই চলে৷ গাড়ি ছুটে যায় ১৪০ গতিতে (হয়তো তার চেয়েও বেশি, কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি ১৪০ পর্যন্ত), কার্যত ব্রেক কষে জরুরি ইন্ডিকেটর লাগিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। জায়গায় না গেলে বিশ্বাসই করা যায় না যে, এমন অদ্ভুত ও একমাত্র জায়গা পৃথিবীর বুকে রয়েছে, তা–ও মদিনায় (ইউটিউবে অনেক ভিডিও রয়েছে)।
জাদুর পাহাড় দেখে ঝটপট মসজিদুন নববিতে জুমার নামাজ পড়ার জন্য ফিরে এলাম। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখার জন্য৷ যা আগেও দেখেছি এবং মদিনায় গেলে সবাই দেখে থাকে৷ পবিত্র ওহুদের ময়দান, কুবা মসজিদ, দুই মিম্বরের মসজিদ, সাবাহ (সাত) মসজিদ, বেলাল মসজিদ ইত্যাদি। ওগুলোর চারপাশে ১০ বছর আগেও বেশ খালি ছিল, এখন দিন দিন ঘনবসতি হয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে ছিল আমার আত্মীয় জিলান ও তার বন্ধুরা৷ তারা গাইডের মতো সব দেখিয়েছে। কুবা মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে এশার নামাজের আগে আগে ফিরে গেলাম মসজিদুন নববিতে। সেখানে নামাজ শেষে ‘রিয়াসুল জান্নাত বা জান্নাতের বাগিচা’, অর্থাৎ রওজা ও মিম্বরের মাঝামাঝি জায়গায় নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে গেলাম।
নামাজ পড়ার জন্য ব্যবস্থাটা আগের চেয়ে এখন বেশ ভালো৷ আগে সেখানে নামাজ পড়া মুশকিল হতো৷ এখন নিরাপত্তাকর্মী আছেন৷ প্রত্যেককে সুযোগ দেওয়া হয়, একদল নামাজ পড়ে বেরিয়ে গেলে আরেক দল প্রবেশ করে৷ খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে নামাজ পড়া যায়। আলহামদুলিল্লাহ। আমি দাঁড়িয়েছিলাম মাঝামাঝি৷ সেখান থেকে খুব সহজে ও স্পষ্টভাবে পবিত্র রওজা শরিফের ভেতরটা দেখা যায়৷ পবিত্র রওজা শরিফের ভেতরে যা দেখলাম, তা বলা সম্ভব নয়, শুধু এইটুকু অনুভব করলাম, আমার বুক কেঁপে কান্না এল এবং অনুশোচনায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷
রাতেই ফিরে গেলাম জেদ্দায়, সুমনের বাসায়। সেখান থেকে পরদিন মক্কায় যাব, ওমরা করব, মক্কার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখব, তারপর যথারীতি ফিরে যাব আমার কর্মস্থলে। একাধিকবার মদিনা সফর করেও এবারের মতো এতটা মুগ্ধ হইনি, এই প্রথমবার মদিনা সফর করে ভালো লাগল, আলহামদুলিল্লাহ। ভুলব না জিলান, শামীম ও সঙ্গ দেওয়া তাদের বন্ধুদের, ভুলব না তাদের আতিথেয়তা। তারা এতটাই আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে যে, ইবাদত করার কথাই ভুলে যেতে বসেছিলাম।